উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যেকে সামনে রেখে ১৯৭৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি দি ইন্সটিটিউট অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ গঠিত হয়।
ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার উদ্দেশ্য মহৎ হলেও এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বাংলাদেশে এমন অনেক বড় বড় এমডি, এএমডি, ডিএমডি কিংবা খ্যাতনামা ব্যবস্থাপক আছেন যারা ডিপ্লোমা না দিয়েও ব্যাংকিং ইন্ডাস্ট্রি শাসন করতেছেন। তারা কি ব্যাংক পরিচালনা করতেছে না? ব্যবসায় আনতেছে না? তারা কি প্রায়োগিক জ্ঞান বা অভিজ্ঞতালব্দ জ্ঞান প্রয়োগ করতে পারেন না? ডিপ্লোমা না করলে কি চৌকষ ব্যবস্থাপক হওয়া যায় না? তারপরও কেন ডিপ্লোমা নামক বস্তা পঁচা একটা পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যাংকারদের ঘাড়ে চাঁপিয়ে দেওয়া হচ্ছে? দিন রাত ব্যাংকে গাঁধার মতো খাটুনি করে শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পড়াশোনা করে প্রস্তুতি নেয়া সকলের পক্ষে সম্ভব হয় না। তার উপর ব্যাংকাররা নানারকম টার্গেটের ভারে জর্জড়িত। নো কস্ট, লো কস্ট ডিপোজিট আনা। রিকোভারি করা। কাস্টমার ধরে রাখা বা ফলোয়াপ করা। এসব কাজ করে ঘরে ফিরে পরিবারকে সময় দিবে দূরের কথা ছোটবেলার মত বই,কলম আর খাতা নিয়ে বসা যেন মাথায় কুড়াল মারা। তারউপর অনেকের হয়তো পাঁচ বছর, একযুগ হয়ে গেছে বই ছেড়ে এসেছে। বুড়ো বয়সে এসে কি লিখবে তাই বাধ্য হয়েই অনেকের মধ্যে হয়তো নকলের প্রবণতা দেখা যায়। সে কারণেই আইবিবি পরীক্ষায় ব্যাংকাররা নকল করে পরীক্ষা দেয় এই ধারণা প্রচলিত আছে। যদিও আজকাল অনেক কমে গেছে। তবে নকল করেই হোক আর না করেই হোক কোনভাবেই পাশ করার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় না। অনেকেই বলেন ব্যাংকিং ডিপ্লোমা (আইবিবি’র) পরীক্ষায় পাশ করা অনেকটা লটারির মত। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষার খাতা দেখা হয় না। ভালো লিখেও অনেকে ফেল করে, ভালো না লিখেও অনেকে পাশ করে। এই ধারণার সত্যতা কতটুকু তা কেবল আইবিবি কর্তৃপক্ষই ভাল জানেন। অনেকে এখানে বাণিজ্যের নগ্নতাকেও খুঁজে পান।
এমনও দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা আইবিএ কিংবা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও ব্যবসায় শাখায় বিবিএ, এমবিএ বা অনার্স, মাস্টার্স করেও অনেক ব্যাংকারই ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় নিজ বিষয়ে প্রথমবারে পাশ করতে পারেন না। তাছাড়া যারা ব্যবসায় শিক্ষা ছাড়া অন্য কোন বিভাগের শিক্ষার্থী তাদের জন্য প্রস্তুতি নেয়াটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। আবার ব্যবসায় শিক্ষার শিক্ষার্থী হলেও কি হবে এদেশের শিক্ষা পদ্ধতির সাথে চাকুরী জীবনে প্রবেশের পরীক্ষা পদ্ধতি সাংঘর্ষিক। চাকুরীর প্রস্তুতি নিতেই ছাত্রজীবনে কি পড়ে আসছে তা অনেকেই বেমালুম ভুলে যায়। সেক্ষেত্রে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার পরীক্ষায় যারা যে বিভাগ থেকে আসুক না কেন সবার জন্যই একটি চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। যদিও ব্যাংকাররা অনেকেই ব্যাংকিং ডিপ্লোমার বিষয়গুলো আগেই পড়ে এসেছে। তারপরও তাদেরকে পঠিত বিষয়গুলোই আবার পরীক্ষা দিতে হয়। পাশ ফেলের টেনশন করতে হয়। আবার প্রত্যেক বছর ফলাফল প্রকাশের পর অনেক ব্যাংকার ফলাফল রিভিউ করার জন্য আবেদন করলেও ফলাফল পরিবর্তন হয় এমন ব্যক্তির সংখ্যা খুবই নগন্য। উল্টো অর্থের অপচয় হয় মাত্র।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। পরীক্ষার সিট যে কেন্দ্র স্কুল বা কলেজে পরে সেখানকার শিক্ষক বা ম্যাডামরা ব্যাংকারদের সাথে যা ইচ্ছা তাই আচরন করেন। খাতা টেনে নিয়ে যায়। কখনও নানা রকম কটু কথা বলে। হল থেকে বের করে দেয়। বলতে গেলে মানুষই মনে করে না ব্যাংকারদের। তারপরও ভদ্রতা আর ধৈর্যের খাতিরে ব্যাংকাররা চুপ করে থাকেন। ব্যাংকিং ডিপ্লোমা বা আইবিবি মূল্যহীন একটা পরীক্ষা বর্তমান সময়ে যার কোন গ্রহণযোগ্যতা নাই বলে অনেকেই বলে থাকেন। বরং এ পরীক্ষাটির কারণে সকল ব্যাংকারকেই পরীক্ষার হলে হেনস্থার স্বীকার হতে হয়। এই ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাকালীন দেশে এখনকার মতো বিবিএ এমবিএ বা অন্যকোন প্রফেশনাল ডিগ্রি ছিল না। শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি অনেকে হয়তো তৎকালীন সময়ে সাধারণ এসএসসি বা এইচএসসি পাশ করেই ব্যাংকে জয়েন্ট করেছেন। কর্মকর্তারা ততবেশি ব্যাংকিং সহায়ক পড়াশুনারও সুযোগ পেতেন না। তাই এসব বিষয়গুলো বিবেচনায় রেখে ব্যাংকিং খাতে অধিকতর দক্ষ ও প্রায়োগিক জ্ঞান সম্পন্ন কর্মকর্তা তৈরির লক্ষ্যে এবং ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট মৌলিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ব্যাংকারদের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে সে সময়ে ব্যাংকিং ডিপ্লোমার ব্যবস্থা করা হয়।
গত একযুগ বা তারও বেশি বছর ধরে এদেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষার সাথে সমন্বয় রেখে এবং প্রতিযোগিতা আর সময়ের চাহিদায় নতুন নতুন বিষয় বা প্রফেশনাল ডিগ্রির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ যারা দেশের বিভিন্ন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন তারা এসব বিষয়গুলোই (যা আইবিবি’র সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত আছে) পড়াশুনা করে তারপর প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় লড়াই করেই চাকুরী পেয়েছে। তারপরও আবার পঠিত বিষয়গুলোকেই ব্যাংকিং ডিপ্লোমায় রাখা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি অবাক লাগে বর্তমান যুগেও বিবিএ, এমবিএ বা এমন প্রফেশনাল ডিগ্রিকে গুরুত্ব না দিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে ব্যাংকিং ডিপ্লোমাকে। যার অবস্থানকে আরও বেশি সুসংহত করল বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৩ অক্টোবরের আকস্মিক সার্কুলার। যেখানে ব্যাংক কর্মকর্তাদের পদোন্নতিতে ব্যাংকিং ডিপ্লোমায় নির্ধারিত নম্বর রাখার জন্য ব্যাংকগুলিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অথচ এই ডিপ্লোমা নিয়ে সকল ব্যাংকারদের নানা অভিযোগের কমতি নাই। সেখানে সকল ব্যাংকারদের আশ্রয়স্থল বা বিপদের কান্ডারী বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সার্কুলার সবাইকে আহত করেছে বলে অনেকেই মনে করেন। আরেকটি কথা না বললেই নয় যে, বর্তমানে এমবিএ প্রফেশনাল কোর্সটি ব্যবসায়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি কলা আর বিজ্ঞানের বিভাগের শিক্ষার্থীরাও ডিগ্রিটি নিয়ে থাকেন। এতকিছুর পরেও ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে হবে। পাশ করতে হবে। তারপর পদোন্নতির জন্য বিবেচিত হবেন। ফেল করলে বছরের পর ঝুলে থাকতে হবে। ব্যাপারটি দুঃখজনক।
বাংলাদেশে ব্যাংকিং সেক্টরের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান দি ইন্সটিটিউট অব ব্যাংকারস, বাংলাদেশ (আইবিবি) কতটুকু কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারছে তা এদেশের ব্যাংকিং পাইওনিয়ররাই মুল্যায়ন করবেন। অন্যদিকে ব্যাংকারদের পদোন্নতিতে নির্ধারিত নম্বর রাখার অনভিপ্রেত নির্দেশনা পুর্ণবিবেচনা করে ব্যাংকারদের গলার কাঁটা নামক ব্যাংকিং ডিপ্লোমার পরীক্ষার সিলেবাস সংশোধণ, আধুনিকায়ণ ও দুই পর্বের পরীক্ষা পদ্ধতিকে ঢেলে সাঁজিয়ে আরও যুগোপযোগী করা হউক দেশের সকল ব্যাংক কর্মকর্তাদের এটাই প্রত্যাশা।
লেখকঃ মুহাম্মদ আমিনুল ইসলাম, ব্যাংকার